ফেসবুক হ্যাকিং
এখনকার সময়ে ফেসবুক যেন আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে, বর্তমান যুগে ফেসবুক একাউন্ট নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারির সংখ্যা প্রায় ২.৬ বিলিয়ন এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকরির সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ।
তবে এখন ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালে এসে সেই সংখ্যাটা দাড়িয়েছে ৪ কোটির ওপরে। করোনা কালের এই পরিস্থিতে ইন্টারনেট এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যাটা আরো দ্বীগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন কিভাবে ফেসবুক আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
ফেসবুক এখন আর শুধু সামাজিক যোগাযোগের মধ্যে সিমাবদ্ধ নেই, আমরা জেনে না জেনে নিজের অজান্তেই ফেসবুকে আমাদের ফুটপ্রিন্ট রেখে যাচ্ছি। কোথায় কবে ঘুরতে যাচ্ছি, কখন কি কাজ করছি সব আমরা ফেসবুকে শেয়ার করছি, বিশেষ করে আরো একটা ব্যপার দেখা যায় একান্ত ব্যক্তিগত ছবি ফেসবুকে ম্যাসেজের মাধ্যমে আদান-প্রদান করা হচ্ছে। কখনো কি ভেবে দেখেছেন ফেসবুক আসলেই কতটুকু নিরাপদ? আপনার একাইন্ট কি ১০০% নিরাপদে আছে? নাকি ইতিমধ্যে কোন হ্যাকারের কবলে পড়ে গেছে?
এই বিষয়টা অবশ্যই চিন্তার বিষয় কারণ ইদানিং প্রায়ই শোনা যায় ফেসবুক আইডি হ্যাক হচ্ছে। কিছুদিন আগে প্রায় ৫ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য হ্যাক হয়ে যায়। এই তালিকায় বাংলাদেশ ও পিছিয়ে নেই, প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইমের কাছে অসংখ্য অভিযোগ আসছে ফেসবুক আইডি হ্যাক হবার। মূলত আমাদের দেশে এই সংখ্যাটা প্রতিনিয়ত আরো দ্বীগুণ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে । এর প্রধান কারণ সকল প্রান্তের মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌছে যাওয়া, যাদের সাইবার সিকিউরিটি সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই এবং ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা না নেই।
একটি ফেসবুক আইডি মানুষের ব্যাক্তিত্ব প্রকাশ করে। কারো প্রফাইলে ভিজিট করলেই মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায় উক্ত ব্যাক্তি সম্পর্কে। এছাড়া একটি ফেসবুক একাউন্টে নানা ধরণের ব্যাক্তিগত ইনফরমেশন সহ অনেক কিছু জড়িত থাকে যা কোন হ্যাকারদের হাতে পড়ে গেলে ভয়াণক ধরণের ক্ষতি হতে পারে। তবে চিন্তার কোন কারণ নেই আজকে এই লেখার মাধ্যমে আপনি নিজেই দেখতে পারবেন আপনার একাউন্টটি নিরাপদে আছে কিনা এবং সেই সাথে জানতে পারবেন কিভাবে আপনার আইডি হ্যাকারদের হাত থেকে বাঁচাবেন, তো চলুন কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক।
ফেসবুক একাউন্ট নিরাপদ রাখার উপায়
নাম্বার ১- নিরাপদ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। অধিকাংশ মানুষ খুব সহজ ধরণের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে যেমন: কোন প্রিয় মানুষের নাম, নিজের ফোন নাম্বার বা সহজেই তাঁর ব্যাক্তিত্বের সাথে অনুমান করা যায় এই ধরণের পাসওয়ার্ড ব্যাবহার করে থাকে, তাই এই ধরণের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা থেকে দূরে থাকুন, পাসওয়ার্ড কমপক্ষে ৮ অক্ষরের হতে হবে, সব থেকে ভালো হয় ১২ অক্ষরের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করলে । পাসওয়ার্ডে সংখ্যা,ছোট হাতের বড় হাতের অক্ষর এবং চিহ্ন ব্যবহার করুন। উদাহরণসরূপ: (“HAr#W`*97Cc)
নাম্বার ২- আপনার একাউন্ট টি যে ই-মেইল বা ফোন নাম্বার দিয়ে খোলা হয়েছে চেষ্টা করবেন সেটা যেন কেউ না জানে।
নাম্বার ৩- ইদানিং কয়েকটা ঘটনা দেখা গেছে, ভূয়া ভোটার আইডি কার্ড বানিয়ে যে আইডি কে টার্গেট করা হয়েছে সেই আইডির নকল মালিক সেজে ফেসবুক কৃতপক্ষের কাছে আপিল করছে । তাই আপনার জন্ম তারিখ,মাস,সাল এইসব হাইড করে রাখুন, অন্তত জন্মসাল হাইড করে রাখুন।
নাম্বার ৪- ( Security and Login ) অপশন থেকে ( Get alerts about unrecognized logins ) এই অপশন টি অন করে রাখুন, এতে করে কেউ যদি আপনার আইডি অচেনা কোন ডিভাইস অথবা ব্রাইজার থেকে লগিন করার চেষ্টা করে তাহলে আপনার ই-মেইলে একটি ই-মেইল চলে আসবে এবং আপনি সাথে সাথে তা জানতে পারবেন।
নাম্বার ৫- ( Security and Login ) অপশন থেকে ( Two-Factor Authentication ) অপশনটি অন করে দিন, এতে করে কেউ যদি আপনার একাউন্টের পাসওয়ার্ড জেনে যায় তবুও লগিন করতে পারবে না, প্রথমে আপনার মোবাইলে একটি কোড আসবে সেই কোড সাবমিট করার পর লগিন করতে পারবে। তাই অবশ্যই এই অপশন টি চালু করে রাখবেন, একাউন্ট নিরাপদে রাখতে এই অপশনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নাম্বার ৬- ( Security and Login ) অপশন থেকে ( Trusted Contacts ) অন করে আপনার পরিচিত কাছের ৩-৫ জন ব্যাক্তি কে এড করে রাখুন। এই অপশনটি চালু থাকলে আপনার আইডি লক হয়ে গেলে উক্ত ব্যাক্তিদের আইডির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে পারবেন কোন ঝামেলা ছাড়াই।
নাম্বার ৭- প্লে-স্টোর ছাড়া কোন থার্ড পার্টি জায়গা থেকে এপস ডাউনলোড করবেন না । এই ধরণের এপস গুলো খুবই বিপদ জনক হয়ে থাকে, আপনার ফেসবুক আইডি থেকে শুরু করে আপনার স্মার্ট ফোনে যত ধরণের আইডি আছে এমন কি আপনার ফোনের পুরো কন্ট্রোল হ্যাকারদের কাছে চলে যেতে পারে। একবার ভেবে দেখুন তো কেন গুগোল এই ধরণের এপস গুলো প্লে-স্টোরে রাখেনি? কারণ গুগোল ভালো করেই জানে এই ধরণের এপস গুলো ব্যবহারকরিদের জন্য ক্ষতিকারক।
নাম্বার ৮- মেসেজে অথবা অন্য কোথাও না জেনে কোন লিঙ্কে ক্লিক করবেন না, এটাকে হ্যাকিংয়ের ভাষায় বলে ফিশিং এট্যাক। লিঙ্কে ক্লিক করার পর আপনি দেখতে পারবেন ফেসবুকের মতো সাইট চলে এসেছে এবং আইডি,পাসওয়ার্ড দিয়ে লগিন করতে বলছে, আপনি লগিন করলেন তো ফেসে গেলেন। আপনি যেই ইনফরমেশন দিয়ে লগিন করবেন হ্যাকারদের কাছে তা চলে যাবে এবং সাথে সাথে আপনার আইডি হ্যাক করে কন্ট্রোল নিয়ে ফেলবে। তাই কোন লিঙ্কে ক্লিক করার আগে অবশ্যই খুব ভালোভাবে ইউআরএল চেক করে নিবেন।
নাম্বার ৯- আপনি যে ই-মেইল আইডি দিয়ে ফেসবুক একাউন্ট খুলেছিলেন সেই ই-মেইলের কোন লিঙ্কে ক্লিক করার সময় ভালো করে যাচাই করে নিবেন। হ্যাকারা আপনার ইমেল কে টার্গেট করে একশন নিতে পারে তাই খুব সাবধানে ইমেলের মেইল গুলো চেক করবেন।
নাম্বার ১০- আপনার নিজের ডিভাইস ব্যতীত অন্য কোন ডিভাইস বা সাইবার ক্যাফে তে আইডি লগিন করবেন না। যদি খুব প্রয়োজন পড়ে লগিন করার তাহলে কাজ শেষে ব্রাইজার হিট্রোরি রিমুভ করে দিন এবং কোন পাসওয়ার্ড সেভ হয়ে আছে কিনা তা ভালোভাবে চেক করে নিন। সব থেকে ভালো হয় ( incognito mode, Private browsing ) করুন।
নাম্বার ১১- ( Security and Login ) অপশন থেকে ( Where You’re Logged In ) এই অপশনে যান এবং সেখান থেকে ( See More ) অপশনে ক্লিক করে দেখুন আপনার আইডি কোথায় কোন ডিভাইসে লগিন আছে, যদি দেখতে পান অচেনা কোন ডিভাইস বা লোকেশন শো করছে তাহলে ডান পাশের অপশনে ক্লিক করে লগ আইট করে দিন, তাহলে সেই অপরিচিত ডিভাইস থেকে লগআউট হয়ে যাবে।
নাম্বার ১২- প্রোফাইল লক করে রাখুন । অনেক সময় হ্যাকাররা আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে থেকে তথ্য হাতিয়ে নিয়ে আপনাকে টার্গেট করতে পারে তাই অপরিচিত কাওকে ফ্রেন্ড লিস্টে রাখবেন না।
নাম্বার ১৩- চেষ্টা করুন ভালো মানের পেইড এন্টি ভাইরাস ব্যবহার করার, এন্টি ভাইরাস আপনার সব ধরণের একাউন্ট সহ আপনার ডিভাইসটিকে সুরক্ষিত রাখবে। বর্তমানে বাজারে খুব স্বল্পমূল্যের মধ্যেই ভালো মানের এন্টি ভাইরাস পাওয়া যায়।
নাম্বার ১৪- যেখানে সেখানে আপনার ফেসবুক আইডি পাসওয়ার্ড লিখে রাখবেন না। পাসওয়ার্ড মনে রাখার চেষ্টা করুন।
নাম্বার ১৫- একই পাসওয়ার্ড সব ধরণের একাউন্টে ব্যবহার করবেন না। এই ভুলটা অধিকাংশ লোক করে থাকে। যেমন: মেইল একাউন্টে যেই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেছে সেই একই পাসওয়ার্ড আবার ফেসবুক,ইনইস্টাগ্রাম,ওয়াটসাপে ব্যবহার করে । এই ধরণের কাজ থেকে বিরত থাকুন কেননা এতে করে আপনার যে কোন একটি আইডি হ্যাকারদের কবলে পড়ে গেলে সব আইডি হ্যাক হয়ে যাবে।
পরিশেষে আরো কিছু কথা বলতে চাই
দেখুন ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগের একটা মাধ্যম এর ব্যতীত কিছুই না, তাই দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ফেসবুক কে জড়াবেন না, যতটা সম্ভব পারসোনাল ছবি বা ব্যক্তিগতসম্মানে আঘাত আনতে পারে এমন ইনফরমেশন শেয়ার থেকে দূরে থাকুন। ফেসবুকে আগে একজন ব্যাক্তি একাধিন আইডি ব্যবহার করতে পারতো কিন্তু দিন বদলের সাথে সাথে ফেসবুক কড়া নিয়ম-নীতি অবলম্বন করছে। তাই একাধিক আইডি ব্যাবহার করা থেকে বিড়ত থাকুন। একাধিক আইডি ব্যবহারের ফলে আপনার ফেক আইডি এবং রিয়েল আইডি দুইটাই ডিজেবল হয়ে যেতে পারে।
তো এই ছিলো ফেসবুক আইডি হ্যাকিং থেকে বাঁচানোর ১৫ টি উপায় । আশা করি তথ্যগুলো আপনাদের খুব কাজে লাগবে। যদি এই লেখাটি পড়ে আপনাদের উপকারে আসে তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না এবং এমন সব তথ্য পেতে আইটি কথার সঙ্গে থাকুন ।