হ্যাকিং কি? হ্যাকিং কত প্রকার?

সম্প্রতি বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে বাংলাদেশ ব্যাংক সহ আরও ২০০টি প্রতিষ্ঠান হ্যাকের খবর প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয় বড় কোন ক্ষতি না করে শুধু কিছু ডাটা চুরির ঘটনা ঘটেছে। সেখানে আরও বলা হয় হাফনাম নামক হ্যাকার গ্রুপ এই কাজ করেছে। ঘটনা যাই হোক অনলাইনে যে ডাটা সুরক্ষিত রাখা কঠিন তা এরকম বিচ্ছিন্ন হ্যাকিং এর ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। 

টেকনোলজি যত উন্নত হচ্ছে তার সাথে সাথে অনলাইনে আমাদের পার্সোনাল ডাটার ভাণ্ডার তত বড় হচ্ছে। এর সাথে সাথে হ্যাকিং এর শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের আজকের পোস্টে আমরা হ্যাকিং কি? হ্যাকিং কত প্রকার? তা নিয়ে আলোচনা করবো। এগুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা থাকলে অনলাইনে নিজেকে হ্যাকিং থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।

হ্যাকিং কি?

হ্যাকিং একটি ডিজিটাল আর্ট। দীর্ঘ সময়ের প্র্যাকটিস এবং মেধার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে এই আর্ট রপ্ত করা সম্ভব। যাইহোক, হ্যাকিং হলো এমন একটি কার্যক্রম যা দ্বারা ইন্টারনেট কানেক্টেড ডিভাইসের আনঅথরাইজড অ্যাক্সেস নেওয়া হয়। এরকম চুরি করে অ্যাক্সেস নিয়ে টার্গেটের ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট, পাসওয়ার্ড সহ অন্যান্য স্পর্শকাতর তথ্য ফাঁস করে দেওয়া অথবা নিজে ব্যবহার করা  এসব হ্যাকিং এর মধ্যে পরে। টার্গেটে প্রবেশ করার জন্য হ্যাকার সিস্টেম এবং নেটওয়ার্কের দূর্বলতা খুঁজে বের করে তা ব্যবহার করে।  

সহজ করে বলতে গেলে কোন ডিভাইস বা নেটওয়ার্কে চুপি চুপি অনুপ্রবেশ করাকে হ্যাকিং বলে। হ্যাকিং এবং হ্যাকার এই দুইটি টার্ম যুব সমাজের কাছে একটি কুল জব। কিন্তু বাস্তবতা আমরা যে রকম ভাবি তেমন না। হ্যাকিংকে প্রায় সব দেশে ক্রাইম হিসেবে দেখা হয়। তবে ধীরে ধীরে এই চিন্তা ভাবনায় অনেক পরিবর্তন আসছে। কি কারণে এ ধরনের পরিবর্তন আসছে তা নিচের লেখা পড়লেই সহজে বুঝতে পারবেন। সময় যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে টেকনোলজি নিয়ে উদাসীন থাকা একদম উচিত হবে না। নিজের তথ্যকে সুরক্ষিত রাখতে আমাদের অবশ্যই হ্যাকিং সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। কারণ হ্যাকিং প্রতিরোধ করতে এবং হ্যাকারের ইন্টেনশন বোঝার জন্য হ্যাকিং সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।

হ্যাকিং কত প্রকার?

হ্যাকিং প্রধানত দুই প্রকার যেমন ইথিক্যাল এবং আনইথিক্যাল হ্যাকিং। হ্যাকিং এর আরও কিছু সাবক্যাটাগরি আছে যেমন সার্ভার বা ওয়েবসাইট হ্যাকিং, কম্পিউটার হ্যাকিং, নেটওয়ার্ক হ্যাকিং, পাসওয়ার্ড হ্যাকিং ইত্যাদি। তবে এসব কিছুই হ্যাকিং এর প্রধান দুই ভাগের মধ্যে পরে। চলুন শুরুতে হ্যাকিং এর প্রধান প্রকারভেদ সম্পর্কে জেনে নেই।

ইথিক্যাল হ্যাকিং

ইথিক্যাল শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ নৈতিক। অর্থাৎ ইথিক্যাল দ্বারা ভালো কাজ বোঝায়। সাধারণত হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারের কাজকে ইথিক্যাল হ্যাকিং বলা হয়। এরা হ্যাকিং করে ভালো উদ্দেশ্যে যা সিস্টেমের ত্রুটি খুঁজে বের করতে সহায়তা করে। এসব ত্রুটি সমাধান করে সিস্টেমকে খারাপ হ্যাকার থেকে দূরে রাখা যায়। ইথিক্যাল হ্যাকিং টার্ম তৈরি করা হয়েছে হ্যাকিং কে ভালো কাজে লাগানোর জন্য।

সাধারণত ইথিক্যাল হ্যাকিং যারা করে তারা টাকার বিনিময়ে অথবা কোম্পানিতে সরাসরি চাকরী করার মাধ্যমে হ্যাকিং করে থাকে। তাদের দায়িত্ব থাকে সিস্টেম এবং নেটওয়ার্ক হ্যাক করে টেস্ট করার জন্য। তারা যদি সঠিকভাবে হ্যাক করতে পারে তাহলে সে সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক পটেনশিয়াল অ্যাটাকারের কাছে ভালনারেবল হয়ে থাকে। তখন সেই ইথিক্যাল হ্যাকারের দায়িত্ব থাকে সিস্টেম এবং নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনকে দুর্বলতার তথ্য ইনফরম করা। এর সাথে তাকে বলে দেওয়া যে কি কি ইমপ্রুভমেন্ট করতে হবে যাতে পুনরায় হ্যাক না হয়।  

আনইথিক্যাল হ্যাকি

হ্যাকিং দুনিয়ায় অনৈতিক এবং ক্ষতিকারক কাজ যারা করে তাদের আনইথিক্যাল হ্যাকার বলে। তাদের করা কাজকর্ম গুলোকে বলা হয় আনইথিক্যাল হ্যাকিং। ইথিক্যাল হাকিং এ যেমন সিস্টেম এবং নেটওয়ার্ককে সুরক্ষিত রাখতে হ্যাক করা হয় আনইথিক্যাল হ্যাকিং এ তার উল্টো টা হয়। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে হ্যাকার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে হ্যাক করে। সারা বিশ্বে আনইথিক্যাল হ্যাকিং কে ঘৃণা করা হয়। কারণ তারা তাদের মেধা খারাপ কাজে লাগায় এবং মানুষকে হয়রানির শিকার করে।

ইথিক্যাল এবং আনইথিক্যাল হ্যাকিং এর বাইরেও আরও কিছু হ্যাকিং প্রকারভেদ আছে। চলুন সেগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ওয়েবসাইট/সার্ভার হ্যাকিং

ওয়েবসাইট বা সার্ভার হ্যাকিং বিশ্বব্যাপী অনেক পপুলার। বিশেষ করে ওয়ার্ডপ্রেসে তৈরি করা অনেক ওয়েবসাইটের হ্যাক হওয়ার ঘটনা প্রায় শোনা যায়। এছাড়া অনেক দেশের সরকারী ওয়েবসাইট প্রায় সাইবার ওয়্যারের আউতায় হ্যাকের শিকার হয়। ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট সহ বড় ওয়েবসাইট এবং সার্ভার গুলো প্রায় সময় হ্যাকিং এর শিকার হয়।

পাসওয়ার্ড হ্যাকিং

কোন অ্যাকাউন্টে ডিরেক্ট অ্যাক্সেস নিতে চাইলে আমাদের পাসওয়ার্ডের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট, ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট সহ অন্যান্য অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার জন্য পাসওয়ার্ড হ্যাকিং অনেক জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। পাসওয়ার্ড হ্যাক করার জন্য হ্যাকাররা নিত্য নতুন অনেক পদ্ধতি ব্যবহার করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কিলগার, ফিশিং, ব্রাউজার কুকি এবং সেশন চুরি ইত্যাদি।   

ডার্ক ওয়েবে এ সকল লগইন ডাটা অনেক উচ্চ দামে বিক্রি করা হয়। যারা এসব পাসওয়ার্ড ক্রয় করে তারা এগুলো ইউজ করে ভিকটিমকে ব্ল্যাকমেইল করে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অ্যাক্সেস করে টার্গেটের সব টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে ট্র্যান্সফার করে নেয়। পাসওয়ার্ড হ্যাকিং একটি ভয়ংকর হ্যাকিং পদ্ধতি যা অনেক বেশি মাত্রার ক্ষতি করে দিতে পারে।

নেটওয়ার্ক হ্যাকিং

নেটওয়ার্ক হ্যাকিং একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ নেটওয়ার্কে দূর্বলতা থাকলে হ্যাকার তার অ্যাক্সেস সহজেই নিয়ে নিতে পারে। তারপর সেই অ্যাক্সেস ব্যবহার করে উক্ত নেটওয়ার্কে কানেক্টেড সকল ডিভাইসে ম্যালওয়্যার পাঠিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ নেটওয়ার্কের একটু ত্রুটির কারণে সকল ডিভাইস ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পরে। 

ওয়াইফাই নেটওয়ার্কে দূর্বলতা খুঁজে পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ার কারণে এই নেটওয়ার্ক সাবধানে ব্যবহার করতে হয়। অনেক গুলো হ্যাকিং টুল আছে যার দ্বারা ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক অনেক সহজেই হ্যাক করে ফেলতে পারে। অতএব নেটওয়ার্ক হ্যাকিং থেকে নিজের নেটওয়ার্ক সবসময় পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। পার্সোনাল বা কমার্শিয়াল যে ব্যাপারে হোক এই বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।

কম্পিউটার হ্যাকিং

কম্পিউটার হ্যাকিং অন্যতম একটি হ্যাকিং মাধ্যম। যদিও কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেমে অনেক শক্তিশালী সিকিউরিটি ব্যবহার করা হয় কিন্তু তারপরেও উইন্ডোজ সিস্টেম পূর্বে থেকেই হ্যাকিং এর শিকার হয়ে আসছে। ম্যাক বা লিনাক্স এই ধরনের ঝামেলা থেকে অনেক অংশেই সুরক্ষিত। উইন্ডোজ সিস্টেম হ্যাক হওয়ার জন্য এর ইউজার অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী। 

বিশেষত উইন্ডোজের অনেক প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার পেইড। কিন্তু অনলাইনে সফটওয়্যার গুলোর ক্র্যাক ভার্সন পাওয়া যায় বলে সবাই ক্র্যাক ইউজ করে। এই ক্র্যাক সফটওয়্যার গুলোয় ম্যালওয়্যার সহ অনেক ক্ষতিকারক ভাইরাস ইমপ্লিমেন্ট করা থাকে। এগুলো ইউজ করার কারণে সিস্টেম হ্যাকের জন্য হ্যাকার রাস্তা খুঁজে পায়। এই রাস্তা ধরেই সিস্টেমে প্রবেশ করে ফেলে। 

এভাবে প্রতিনিয়ত অনেক উইন্ডোজ সিস্টেম হ্যাকিং এর শিকার হচ্ছে। এতে ইউজারদের ডাটা বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তবে বর্তমানে উইন্ডোজ সিস্টেমের সিকিউরিটি আগের থেকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উন্নত এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ইউজ করেও কম্পিউটারকে হ্যাকিং থেকে সুরক্ষিত রাখা অনেকটুকু সম্ভব হয়েছে।

নিজের ইউজ করা সিস্টেমের সবোর্চ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করা অতি প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে হ্যাকারদের হাত থেকে নিজেদের সকল ডাটা সুরক্ষিত রাখতে হবে। বর্তমান প্রায় সব কিছু অনলাইন ভিত্তিক হওয়ায় ডাটার পরিপূর্ণ সিকিউরিটি দেওয়া সম্ভব নয়। তবে স্পর্শকাতর ডাটা অনলাইনে ষ্টোর না করাই ভালো। আসা করি এই লেখা পড়ে হ্যাকিং সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। হ্যাকিং সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাবেন ধন্যবাদ।

Leave a Comment