হ্যাক, হ্যাকিং এবং হ্যাকার শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। কারণ আমাদের বর্তমান জীবন অনেকটাই অনলাইন নির্ভর। প্রতিনিয়ত আমাদের প্রযুক্তির সাথে চলতে হয়। আর এ কারনেই হ্যাকার এবং হ্যাকিং শব্দগুলো আমাদের কাছে আতংকের মতো। বস্তুত আমাদের পার্সোনাল ডাটা অনলাইনে সব জায়গায় থাকার কারণে ডাটা হ্যাক হওয়ার ঝুঁকি সব সময় থেকেই যায়। সোশ্যাল মিডিয়া এবং নিউজ মিডিয়ার বদৌলতে হ্যাকিং এবং হ্যাকার সম্পর্কে আমারা ধারণা লাভ করেছি। কিন্তু হ্যাকারদের প্রকারভেদ এবং কার্যকলাপ ইত্যাদি বিষয় গুলো সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক কম। আমাদের আজকের লেখায় আমরা হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার কারা সে বিষয়ে আলোচনা করবো। এতে আশা করি হ্যাকার এবং হ্যাকিং বিষয়ে আপনার পজিটিভ এবং স্বচ্ছ ধারণা হবে।
হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার কারা?
ভালো মন্দ শব্দগুলো আমরা কোন বিষয় এবং বস্তুকে বিচার করার সময় ব্যবহার করি। প্রতিটি বিষয়েই ভালো এবং মন্দ বিষয় আছে। হ্যাকারদের ব্যাপারেও বিষয়টি একই। এখানেও ভালো এবং মন্দ উভয় বিষয় আছে। আপনার মনে হতে পারে হ্যাকার তো অবশ্যই খারাপ কারণ তারা অনুমতি না নিয়ে মানুষের পার্সোনাল ডাটা অ্যাক্সেস করে। তাদের কারণে মানুষের হাজার হাজার টাকা নষ্ট হয়। এই যেমন কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এর রিজার্ভ হ্যাকিং এর শিকার হয়ে অনেকগুলো টাকা হারিয়েছে। যার পেছনের এ সকল হ্যাকারদের হাত আছে।
আসলে ভালো কাজ সহজে নিউজ হয়না, হ্যাকিং এর বিষয়টিও আসলে তেমন। অনেকেই আছে যারা হ্যাকিং দ্বারাও ভালো কাজ করে কিন্তু আমাদের সামনে তা আসে না। অন্যদিকে যারা হ্যাকিং স্কিল টাকে খারাপ কাজে ব্যবহার করে তাদের নিউজ ফলাউ করে প্রচার করা হয়। এ কারণেই আমাদের মাঝে একটি এন্টি হ্যাকার মানুষিকতা কাজ করে। যাইহোক, হ্যাকিং দুনিয়ায় ভালো এবং খারাপ উভয় ধরনের কাজ আছে। আর অনলাইনে হ্যাকিং স্কিল যারা ভালো কাজে প্রয়োগ করে তাদের হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার বলে।
পরিস্কার করে বলতে গেলে যারা অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের অনুমতি নিয়ে সিস্টেম হ্যাক করে দুর্বলতা খুঁজে বের করে এবং তা সমাধানে সাহায্য করে তাকে হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার বলে। হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের আরও একটি পরিচয় হলো তারা সিকিউরিটি এক্সপার্ট। অর্থাৎ তারা একই সাথে হ্যাকিং এবং তা রোধ করার জন্য নিত্যনতুন টেকনোলজি ও পদ্ধতি তৈরি করে।
উদাহরণস্বরূপ ধরুন আপনার একটি নেটওয়ার্ক ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে। সেখানে একই সাথে আপনার পুরো কোম্পানির নেটওয়ার্ক সংযুক্ত। এখন এই নেটওয়ার্কে কোন হ্যাকার প্রবেশ করলে সে আপনার কোম্পানির সকল ধরনের ডাটা অ্যাক্সেস করতে পারবে। আপনার ফিনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট এর অ্যাক্সেস নেওয়া সহ সকল ট্রানজেকশন পেয়ে যাবে। আপনি পুরো বিষয় ক্লিয়ার হওয়ার আগেই আপনার সবকিছু হ্যাকার নিয়ে উধাও হয়ে যাবে। অন্যদিকে ইন্টারনেটের সাথে কানেক্টেড প্রায় সব কিছুই হ্যাক করা যায়। এখন আপনি আপনার নেটওয়ার্ক ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউর করবেন কীভাবে?
ঠিক এই জায়গায় আপনার প্রয়োজন পরবে একজন হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারের। কারণ সে জানে কীভাবে হ্যাকিং করতে হয়। সে হ্যাকারের মত চিন্তা ভাবনা করতে পারে। হ্যাকার যে ভাবে আপনার সিস্টেমে প্রবেশ করেছে সে সেই দুর্বলতা খুঁজে বেড় করতে পারবে। সেই সমস্যা সমাধানের জন্য কি কি করতে হবে তাও সে বলে দিতে পারবে।
আপনি চাইলে সে নিজে তা সমাধান করে দেবে। এমনকি আপনি তাকে এই কাজের জন্য জব অফার করলে সে তা গ্রহণ করে নিতে পারে। যার কারণে পরবর্তীতে আপনার কোম্পানির সিকিউরিটির জন্য আর আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। মোটকথা হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার হলো সিকিউরিটি এক্সপার্ট, পেনেট্রেশন এক্সপার্ট, কম্পিউটার হ্যাকার এবং সিকিউরিটি রিসার্চার। তাদের কার্যকলাপকে বর্তমানে ইথিক্যাল হ্যাকিং বলে। এর কারণ তারা আইন মেনে প্রোপার ওয়ে তে তাদের হ্যাকিং চর্চা করে যা মানবজাতির উপকারে লাগে।
ইথিক্যাল হ্যাকিং কি?
ইথিক্যাল হ্যাকিং হলো নৈতিক ভাবে হ্যাকিং করা। অর্থাৎ যে হ্যাকিং এর পেছনে কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই এবং যা দ্বারা মানুষের কোন ক্ষতি হয়না তাই ইথিক্যাল হ্যাকিং। বর্তমানে ইথিক্যাল হ্যাকিং টার্ম অনেক পপুলার কারণ হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের ইথিক্যাল হ্যাকার নামেই ডাকা হয়।
কোম্পানিগুলো তাদের সিস্টেম চেক করে দেখার জন্য ইথিক্যাল হ্যাকারদের জব দিচ্ছে। সিস্টেমের সিকিউরিটি আরও শক্ত করার জন্য ইথিক্যাল হ্যাকারদের সাহায্য নিচ্ছে। ইথিক্যাল হ্যাকাররা হোয়াইট হ্যাট পদ্ধতিতে তাদের হ্যাকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে।তারা কাজের শুরুতে সিস্টেম এবং নেটওয়ার্কের দুর্বলতা খোঁজার জন্য পেনেট্রেশন টেস্টিং করে। এতে তারা বিভিন্ন ইথিক্যাল হ্যাকিং টুল ইউজ করে। টুল গুলোর রিপোর্ট অ্যানালাইজ করে সমস্যা খুঁজে বেড় করে। তারপর সেগুলো সমাধানের রাস্তা বেড় করে। হ্যাকার যাতে বারবার সিস্টেমের অ্যাক্সেস নিতে না পারে সে জন্য ব্যাকডোর খুঁজে তা বন্ধ করে দেয়। অনেক কোম্পানি ইথিক্যাল হ্যাকিং এর উপর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছে। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
হোয়াইট হ্যাট হ্যাকিং শেখার প্রয়োজনীয়তা
হোয়াইট হ্যাট হ্যাকিং কে একটি অস্ত্রের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কারণ এর উদ্দেশ্য এবং কার্যকলাপ অস্ত্রের মতই। বিশেষত ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকিং প্রতিরোধ করার জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি হোয়াইট হ্যাট হ্যাকিং কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
হোয়াইট হ্যাট অথবা ইথিক্যাল হ্যাকিং যেটাই বলিনা কেন, হ্যাকিং থেকে বাঁচার জন্য আমাদের হ্যাকিং শিখতেই হবে। এছাড়া বর্তমানে ইথিক্যাল হ্যাকারদের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠান গুলো তাদের সিস্টেম এবং নেটওয়ার্ক সুরক্ষিত রাখার জন্য হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের হায়ার করছে। এতে যেমন নিজের স্কিল বাড়ছে তেমনি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বাড়ছে। তাছাড়া এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে নিজেকে আপডেটেড রাখার জন্য যেমন নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়ানো দরকার। তেমনি সিকিউরিটির উপর আরও বেশি বেশি গবেষণা এবং কন্ট্রিবিউশন প্রয়োজন।
এসকল দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ইথিক্যাল হ্যাকিং অথবা হোয়াইট হ্যাট হ্যাকিং শেখা এখন সময়ের দাবী। বিশ্বে নিজের অস্তিত্ব ও ক্ষমতা প্রমাণ করার জন্য টেকনোলজিতে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নিজেকে ইনফরমেশন টেকনোলজিতে আরও বেশি পারদর্শী করে তুলতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে ভবিষ্যৎ দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করবে যার কাছে সব থেকে বেশি ইনফরমেশন থাকবে। আর এসকল ইনফরমেশন যে যত সুরক্ষিত রাখতে পারবে তার ক্ষমতা তত বাড়বে। যার ফলে এখন থেকেই টেকনোলজিতে ইনফরমেশন সিকিউরিটি নিয়ে বেশি বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
একজন উৎকৃষ্ট মানের হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার কেভিন মিটনিক তার সিকিউরিটি বিষয়ক কনফারেন্সে ইন্টারনেট সিকিউরিটির কথা বার বার উল্লেখ করেন। কারণ তিনি শুরুতে ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও পড়ে অপরাধ ছেড়ে ভালো রাস্তা অবলম্বন করা শুরু করেছে। সে হ্যাকিং এর অন্ধকার জগত দেখে এসেছে। তিনি সহ সকল হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারের মতে ইথিক্যাল হ্যাকিং শেখার কারণে মানুষ তার নিজের সেফটি ধরে রাখতে পারবে। হ্যাকিং এর শিকার হয়ে আর্থিক এবং মানুষিক বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।
মোটকথা হোয়াইট হ্যাট হ্যাকিং শেখার বর্তমানে কোন বিকল্প নেই। সেটা নিজের জন্য হোক আর অন্যের জন্য হোক হ্যাকিং শিখতেই হবে। এতে আমরা নিজেরা অনলাইনে সেফ থাকতে পারবো এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে পারবো। আমাদের আজকের আয়োজন ছিল ইথিক্যাল বা হোয়াইট হ্যাট হ্যাকিং নিয়ে। আমাদের অনেকের মনেই এ সকল হ্যাকিং ক্লাসিফিকেশন নিয়ে নানান ধরনের কনফিউশন কাজ করে, আশা করি আজকের লেখা পড়ে হোয়াইট হ্যাট হ্যাকিং সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট হয়েছে। হ্যাকিং সম্পর্কে আপনার মতামত অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন ধনব্যাদ।